০৭ অক্টোবর ২০১৮,
আমার বন্ধুরা যখন ৩ ঘন্টার পরীক্ষায় মগ্ন ছিলো, ঠিক তখন আমি বাথরুমের এক কোণায় বসে নিজের ব্যর্থতার জন্য জল ফেলছিলাম! বাইরে থেকে আম্মু-আব্বু জোরে জোরে দরজা ধাক্কাছিলো। তাদেরকে কিভাবে নিজের মুখ দেখাবো তা বুঝতে পারছিলাম না! এরপর দরজা খুলেই আব্বুর পায়ে ধরে বললাম--"মাফ করে দিও বাবা! পারলাম না তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে, এমনকি নিজের স্বপ্ন পর্যন্ত পৌছাতেও পারলাম না।সেদিন একসময় চোখের পানিও শুকিয়ে গিয়েছিলো,ব্যর্থতার গ্লানি মুছা অনেক কঠিন। টেবিলের উপর বুয়েট এক্সামের প্রবেশপত্র পরেছিলো,যাইনি পরীক্ষা দিতে! ইচ্ছে ছিলো পরীক্ষা দিতে গিয়ে আরেকবার দেখে আসবো, কিন্তু কে জানতো এই দিনে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিবে!........
টানা ২ সপ্তাহের মতো আব্বু সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারিনি।লজ্জায় মাথায় নিচু রাখা ছাড়া আর উপায় ছিলো না আমার। আমাকে বলছিলো অন্যান্য সব জায়গায় পরীক্ষা দিতে কিন্তু স্বপ্ন তো সেই সাদা এপ্রোন। তা ছাড়া যে মন কিছুই মানে না! বন্ধুরাও বুঝে উঠেছিলো যে,আমি ঠিক নাই! তারাও আমাকে তাদের সাথে প্রাইভেটে ভর্তি হতে বলছিলো! আর যারা চান্স পেয়েছি, তারা সেই সময়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। আসলে যার কপালে কালোর আভাস আসে একবার, তার সহজে মেটানো যায় না! বরং এক কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া লাগে।
(give me some sunshine-- 3 Idiots)
এই কঠিন সময়ে আমার জীবনে ছায়া হয়েছিলো ওয়াসি আর তানভীর ভাই! ওয়াসি ভাই আমার এ্যাডমিশনের পুরো সময়ই পাশে ছিলো আর তানভীর ভাই নিজেও তখন সেকেণ্ড টাইমার হয়ে আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলো! আল্লাহর অশেষ রহমতে তানভীর ভাইয়ের সাতক্ষীরা মেডিকেল এসেছে রেজাল্টে। এই দুইজন মানুষের পরামর্শ আর নিজের শক্ত মনোবলের জন্য আমি আরেকটা বছর কষ্ট ও চেষ্টা করার জন্য প্রস্তুত হই! আম্মু-আব্বু কেউই রাজি ছিলো না, বরং তাদের বুঝিয়ে রাজি করাতে সক্ষম হলাম! আসলে বাবা-মা তাদের সন্তানের জন্য অনেক ত্যাগ করে, বিনিময়ে তারা শুধু সন্তানের সুখ চায়!
নভেম্বর ২৭,২০১৮
আব্বুকে সাথে নিয়ে "ম"- কোচিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তায় আমি কেবল আব্বুর দিকেই চেয়ে ছিলাম, রেজাল্টের পর থেকে আমি আব্বুর সামনে কখনো মাথা উচু করে দাড়াতে পারিনি।পৌছানের পর আব্বুকে নিয়ে উঠলাম অফিসে,অফিসের ঠিক বিপরীত রুমে সেলিব্রেশন প্রোগ্রামের অনুশীলন হচ্ছিল(নাচ, গানের)! একপাশে জয়ীদের হাসি-উল্লাস,ঠিক আরেকপাশে পরাজয়ীরা নতুনভাবে নিজেদের জয়ী করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হচ্ছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!! একই ছাদের নিচে সবাই ; শুধু মাঝের এক দেয়াল ভাগ করে দিচ্ছে অনেককিছু।
আব্বু ভর্তি করাচ্ছিলো, ঠিক পিছন থেকে ফারাজ ভাইয়ের সাথে দেখা।
(ফারাজ ভাইয়ের সাথে আমার " র" কোচিং-এর মডেল টেস্টে দেখা হয়েছিলো,উনি নিজেও একজন সেকেন্ড টাইমার ছিলেন। "র"-কোচিং-এর সব পরীক্ষায় তিনি ১-১০ এর মধ্যে থাকতেন)
-- আসসালামু আলাইকুম ভাই! কেমন আছেন?
-- ওয়াআলাইকুমুস সালাম! ভালো রে।তোর কি খবর?
-- এই তো ভাই! সেকেণ্ড টাইম দিবো! তাই ভর্তি হতে এসেছি, আপনার কোথায় আসলো ভাই?
-- আমার হয়নি রে! মানুষের ডাক্তার হওয়ার সৌভাগ্য হয়তো নেই কপালে,তাই ভেটেনারিতে ভর্তি হবো রে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে!
দোয়া রাখিস!!
-- আচ্ছা ভাই! ভাই?
-- আমি জানি তুই কি জিজ্ঞাসা করবি! আফসোস নাই রে! নিজের সেরা চেষ্টা করেছি একটা বছর, হয়তো আল্লাহ ভাগ্যে রাখেনি! আর।পরিবারের সামর্থ্য নেই প্রাইভেটে পড়ানোর! তাই দেখা যাক অন্য জায়গায় নিজের জন্য কিছু করতে পারি নাকি! অনেক শক্ত মনোবল আর ধৈর্য্য লাগে রে! নিজেকে ধরে রাখিস ১০ টা মাস, ইনশা আল্লাহ ভালো কিছু হবে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরী!!
-- ধন্যবাদ ভাই! দোয়া রাখবেন! কপালে থাকলে আবার হয়তো দেখা হবে কখনো!
-- সেটা অবশ্যই! আশা করি তখন তোকে হাস্যজ্জলরুপে দেখবো!! শুভ কামনা রইলো ভাইয়া!
এইরকম মানুষটাকে যে এভাবে দেখা লাগবে তা আগে কখনোই ভাবিনি। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। আব্বু অফিস থেকে বের হয়ে খামটা আমার হাতে দিয়ে বললো-- " এই যে তোমার আইডি কার্ড, ১ ডিসেম্বর থেকে ক্লাস শুরু। ভালো করে পড়িস বাবা " আব্বুর চোখটা জলজল করছিলো, আমি বললাম-- " আচ্ছা আব্বু! আমি নিজের সেরা দেওয়ার চেষ্টা করবো! "
পাশের রুম থেকে জোরে আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো!! একদিন আনন্দ-উল্লাস আর ওপরদিকে নতুন মনোবল তৈরির প্রচেষ্টা।
কেনো জানি নতুন এক উদ্যম আর চেষ্টার ইচ্ছা নিজের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছিলো! বাসায় এসে টেবিলে বসে আবার সেই পুরোনো আজমল-হাসানের বই হাতে নিলাম! শুরু করা যাক নতুন উদ্যমে! ভাগ্যে কি আছে তা জানি না।। তবে চেষ্টা করা যাক! চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই!!
LETS TRY AGAIN FOR THE ONE LAST TIME !!
.
.
.
.
.
to be continued.........
(( সেই একবছরে আমি অনেক কিছু শিখেছি! নিজের চেষ্টার কমতি রাখিনি কিন্তু কপালে হয়তো লেখা ছিলো না। সেই যাত্রায় কিছু ভালো ভালো সহপাঠী, কিছু প্রিয় সিনিয়র ভাইয়া-আপু আর কিছু শিক্ষা। কেউ জয়ী হয়েছিলো দিনশেষে,আবার কেউ আমার মতো।এখন সবাই ভালোই আছে আল্লাহর রহমতে। সব গল্প-কথা তো এক লেখায় প্রকাশ করা যায় না,ইহা কেবল মাত্র সূচনা! আবার হয়তো কোনো মাধ্যমে বাকি গল্প-কথা লেখা যাবে।))
((চেষ্টার শেষ নাই, কিছু পাওয়ার জন্য নিজের সেরাটা দিতে পারলেই নিজেকে সার্থক মনে হয়। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আজও,হয়তো কোনো একদিন আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারবো -- "বাবা, তোমার ছেলে আজ সফল হয়েছে।কোনো কিছুই বিফলে যায়নি!আমি পেরেছি বাবা!! আমি পেরেছি!!"
আর সমাজ তো সমাজই! লোকে তো কথা বলবেই! বলতে দিন! তাদের উপেক্ষা করেই চলাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এবং এতেই আমরা আমাদের বিজয়ের আরো সন্নিকটে আসতে পারবো।))
( আমার এই লেখা শুধুমাত্র তাদের জন্যই যাদের গল্প সবার কাছে পৌছায় না, যারা নিজেদের ব্যর্থতাকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কষ্ট সবাই করে, চেষ্টা সবাই করে কিন্তু সবাই তো দিনশেষে সফল হয় না! আমার এই লেখা তাদের জন্য। উৎসর্গ তোমাদের জন্য♥)
( বিঃদ্রঃ-কাউকে দুঃখ কিংবা কষ্ট দেওয়ার জন্য এই লেখা হয়নি।)
Comments
Post a Comment